হরসিদ্ধি দেবী

           হরসিদ্ধি দেবী 


শ্রীশ্রী হরসিদ্ধি মাতারাণী


হরসিদ্ধি দেবী অবন্তী শক্তিপীঠ এর অধিষ্ঠাত্রী । এটি অষ্টাদশ মহাশক্তিপীঠ এর অন্তর্ভুক্ত। দেবীর ভৈরব লম্বকর্ণ।  পীঠ নির্ণয় তন্ত্র অনুসারে এটি অবন্তী শক্তিপীঠ(পঞ্চম শক্তিপীঠ,এটি উজানি শক্তিপীঠ নয়)। আদি শঙ্করাচার্য রচিত অষ্টাদশ মহাশক্তিপীঠ স্তোত্র এর অন্তর্ভুক্ত। এটি ভারতের মধ্যপ্রদেশ এর উজ্জয়িনী বা অবন্তী নগরে অবস্থিত। পীঠনির্ণয়তন্ত্র এর শ্লোকটি হল,

 ঊর্ধ্বেীষ্ঠো ভৈরব পর্বতে অবন্ত্যাঞ্চ মহাদেবী লম্বকর্ণস্ত ভৈরবঃ।।

দেবীর ভৈরব লম্বকর্ণ বা মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ। এখানে দেবী সতীর ওষ্ঠ পতিত হয়েছিল। পুণ্যসলিলা শিপ্রা নদীর তীরে এখানকার ভৈরব পাহাড়ে  মহাদেব এখানে ‘মহাকালেশ্বর’ নামে পূজিত হন। তাঁর মন্দিরের সন্নিকটেই রয়েছে রুদ্রসাগর সায়র। সেই সায়রের তীরে রয়েছে দেবী মহাকালীর পীঠমন্দির। অষ্টাদশ মহাশক্তিপীঠ স্তোত্র তে তাঁকে মহাকালী বলে বর্ণনা করা হয়েছে ,

উজ্জয়িন্যাং মহাকালী পীঠিকায়াং পুরুহূতিকা ।



            হরসিদ্ধি মুর্তিতত্ত্ব 


হরসিদ্ধি দেবীর চিত্র

মহাকাল সংহিতায় তাঁর ধ্যানমন্ত্র পাওয়া যায় । 

তার তিনটি চোখ ছিল সবুজ খেজুর গাছের মতো সুন্দর। তাঁর চুল তাঁর পদতল পর্যন্ত লম্বা ।  তিনি করোটির মালা পরিহিতা। তিনি নানাবিধ অলঙ্কারভূষিতা । তাঁর বুক বাঘের চামড়া দিয়ে তৈরি বেল্ট দিয়ে ঢাকা ছিল ।

তিনি শবদেহের উপর আরোহণ করেছিলেন । সে চার হাত দিয়ে জ্বলজ্বল করছিল। ডান হাতে তলোয়ার এবং যোগ পাতার তৈরি জপমালা । তাঁর বাম হাতে বৃক্ষপাল ।

উজ্জয়িনীর কথা 


হরসিদ্ধি মন্দির

স্বয়ং শিব জাগ্রত করেছিলেন উজ্জয়িনীর দেবী ‘হরসিদ্ধি’কে

একদা এক সময় উজ্জয়িনীর ভৈরব পাহাড় ছিল গভীর এক জঙ্গলে আবৃত। সেই অরণ্যের নাম ছিল ‘মহাকাল বন’।

 সেই সময় অসুরলোকে ত্রিপুরাসুর নামের এক অসুর দারুণ ক্ষমতা লাভ করে বসেছিল। তার ওপর কঠিন তপস্যা করে ব্রহ্মার কাছ থেকে বর গ্রহণ করেছিল যে, শিবের হাতে ছাড়া আর অন্য কারও হাতে তার মৃত্যু হবে না। মরবে না শিবের এক বিশেষ অস্ত্র ছাড়া। 

ত্রিপুরাসুর ভেবেছিল যে, শিব সর্বদাই ধ্যানে মগ্ন থাকেন, অকালে তাঁর ধ্যান ভঙ্গ করলে তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন( যেমনটা কামদেবের অবস্থা হয়েছিল)। তাই অসময়ে তাঁর ধ্যান ভাঙানোর সাহসই কেউ করে না, তার ওপর তাঁকে দিয়ে বিশেষ অস্ত্র অর্জন করানো তো আরও দুষ্কর। ফলে, মহাদেব সহজে তাঁকে হত্যা করতে আসবেন না, সেও অত সহজে মরবে না।ফলে তার আসুরিক প্রবৃত্তি বহুগুণে বৃদ্ধি পেল। তাতেই সে স্বর্গ আক্রমণ করে দেবতাদের উপর অত্যাচার ও তারপর তাদের বিতাড়িত করে ত্রিলোকের অধীশ্বর হয়ে বসল। 

অতঃপর দেবতারা ব্রহ্মার শরণ নিলেন। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা আবার সকল দেবতাদের নিয়ে এ কাজের অধিকারী শিবের শরণে এলেন। ব্রহ্মাসহ দেবতারা যথাবিহিত বন্দনা ও পূজার মধ্য দিয়ে শিবকে তুষ্ট করে তাঁর ধ্যানভঙ্গ ঘটালেন। তারপর সব শুনে শিব দেবতাদের সহায় হয়ে দুষ্টের দমন করতে রাজি হলেন। তিনি পাড়ি দিলেন মহাকাল বনে। সেখানে গিয়ে দেবী সতীর পীঠের স্থানে গিয়ে তপস্যায় বসলেন। শুরু করলেন দেবী শক্তির আরাধনা। আরাধনা করতে লাগলেন তাঁর হরসিদ্ধি স্বরূপের। দীর্ঘ ও কঠোর তপস্যার পর দেবী হরসিদ্ধি তুষ্ট হয়ে দেখা দিলেন। বললেন, হে মহেশ, তোমার তপস্যায় আমি তুষ্ট, বল কী বর চাও?

দেবী তখন মহাদেবের হাতে এক ভয়ঙ্কর অস্ত্র তুলে দিলেন। যে অস্ত্রের নাম, ‘পাশুপত অস্ত্র’। এই অস্ত্র দিয়েই ভীষণ সংগ্রামের শেষে শিব ত্রিপুরাসুরকে বধ করে দেবতাদের হাতে পুনরায় স্বর্গরাজ্য ফিরিয়ে দিলেন, ত্রিভুবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। 

ত্রিপুরাসুরের বিরুদ্ধে এই বিজয়ের কথা স্মরণে রাখতে দেবতারা ‘অবন্তী’র নাম ‘উজ্জয়িনী’ রাখেন। ‘উজ্জয়িনী’ কথাটা এল ‘উজ্জিত’ থেকে, যার অর্থ, ‘পরাজয়’। অর্থাৎ, এই স্থানে মহাদেব তাঁর প্রবল শত্রুকে পরাজিত করেছিলেন।


মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ

আবার, মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ কিভাবে স্থাপিত হল এই বিষয়েও একটি কাহিনী পাওয়া যায় । একদা এক সময় শ্রীকর নামে একটি পাঁচ বছরের বালক ভগবান শিবের প্রতি উজ্জয়নের রাজা চন্দ্রসেনের ভক্তি দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছিল। শ্রীকর একটি পাথর নিলেন এবং এটিকে লিঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করলেন, তিনি এটিকে নিয়মিত পূজা করতে লাগলেন। অন্যরা বিশ্বাস করত যে তার ধর্ম কেবল একটি খেলা ছিল এবং তাকে যে কোনো উপায়ে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সব প্রচেষ্টাই বৃথা গেল। বরং শ্রীকরের ভক্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে। বালকের ভক্তিতে খুশি হয়ে ভগবান শিব জ্যোতির্লিঙ্গের রূপ ধারণ করেন এবং মহাকাল বনে বাস করেন।

       হরসিদ্ধি দেবীর কাহিনী

একসময় চণ্ড ও প্রচণ্ড নামক দুই অসুর স্বর্গে গমন করে।পরে তারা কৈলাসে গেছিল। সেখানে গিয়ে তাহারা ভগবান মহেশকে দর্শন করে। মহেশ তখন দক্ষিণ করে নাগেশ, শশী ও খট্টাঙ্গ লইয়া দূতক্রীড়ার জন্য 'দেবি দেবি' বলিয়া দেবীকে আহ্বান করছেন । যেমন তিনি দেবীর সতী একটা ফলকে উপস্থিত হলেন, অমনি দ্যূতক্রীড়া আরম্ভ হল, তাহারা যখন দ্যূতে অত্যন্ত আসক্ত হয়েছেন, এমন সময় ঐ দৈত্যদ্বয় গিয়ে ঐ স্থানে উপস্থিত হল। তাদের নন্দী বারণ করলেও অসুররা শিবগণ-সকলকে উৎসাদিত করিয়া ফেলেছিল এবং নন্দীকেও তাহারা শূল দ্বারা দারিত করে । নন্দীর সব্যাসব্য উভয় অবয়ব হইতে রক্তধারা সমভাবে ক্ষরিত হইতে থাকে। তাঁহাকে তথাবিধ প্রস্তুত দেখিয়া দেবদেব দেবীকে ধ্যান করিতে লাগলেন । দেবী তাঁহা কর্তৃক চিন্তিত হয়ে তাহার অগ্রে উপস্থিত হয়ে প্রণাম করলন   দেবদেব তখন তাঁহাকে বললন,—ঐ মহা- দৈত্যদ্বয়কে বধ কর ; দেবী বললন— করছি ; এই বলে তিনি ঘোর মুদ্গার ধারণ করে দৈত্যদ্বয়কে তাড়না করলন   ঐ তাড়নেই তারা পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হল । তখন দেবদেব দেবীর দ্বারা ঐ বলগৰ্ব্বিত দৈত্যদ্বয়কে নিহত দেখে তাঁহাকে বললন,–হে চণ্ডি! তুমি দৈত্যদ্বয়কে নিহত করে আমার ইষ্টসিদ্ধি করলে । তাই তুমি হরসিদ্ধি নামে জগতে খ্যাত হবে ।

উপসংহার 

বলা হয়, স্বয়ং বিক্রমাদিত্য এই দেবীর তপস্যা করতেন । ফলে তিনি অসীম ক্ষমতা পেয়েছিলেন। যাইহোক, হরসিদ্ধি আজও স্বমহিমায় বিরাজমান। উজ্জয়িনীর অন্যান্য বিখ্যাত মন্দিরের তালিকা দেওয়া হল,

১) মহাকালেশ্বর

২) কালভৈরব

৩) গধ কালিকা

৪) বেদশালা

৫) সন্দীপনি আশ্রম

৬) চিন্তামণি গণেশ

৭) ত্রিবেণী নবগ্রহ 

৮) মঙ্গলনাথ

৯) সিদ্ধাথ

১০) গোপাল মন্দির

কখনো উজ্জয়িনী ভ্রমণ করলে এগুলি দেখতে ভুলবেন না কিন্তু !!

!! জয় মা হরসিদ্ধি !!



Comments

Popular posts from this blog

108 Shaktipeethas

Shaktipeethas in Brihad Nila Tantra

Shaktipeethas in Lalitopakhyanam