গন্ধেশ্বরী দেবী

        দেবী গন্ধেশ্বরী

লেখায় - অয়ন্তিক বসু 

ভূমিকা :- 


গন্ধেশ্বরী হলেন আদি পরাশক্তির একটি স্বরূপ । এঁর পূজা বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয়। প্রধানত বাঙলার গন্ধবণিকরা পূজা করেন। 

                                


               [[ গন্ধেশ্বরীর প্রচলিত লৌকিক রূপ ]]

গন্ধেশ্বরী দেবী হলেন শ্রী শ্রী চণ্ডী বা দুর্গা সপ্তশতীর মূলদুর্গা । দেবী মূলদুর্গা র ধ্যান মন্ত্র অনুসারে তিনি পূজিতা হন। যদিও প্রচলিত মুর্তিতত্ত্ব অনুযায়ী তিনি গৌরবর্ণা, চতুর্ভুজা, শঙ্খ-পদ্ম-বরাভয় ধারিণী । এই মুর্তিতত্ত্বএর কোন ধ্যান মন্ত্র নেই । 


মূলদুর্গা ধ্যানম্ 

ওঁ সিংহস্থা শশিশেখরা মরকতপ্রেক্ষা চতুৰ্ভির্ভুজৈঃ । শঙ্খং চক্র- ধনুঃশরাংশ্চ দধতী নেত্রৈস্ত্রিভিঃ শোভিতা ।। আমুক্তাঙ্গদহার- কঙ্কণরণৎ- কাঞ্চীক্কণরূপ রা । দুর্গা দুর্গতিহারিণী ভবতু নো রত্নোল্লসৎকুন্ডলা ৷৷ 


                            [[ দেবী মূলদুর্গা ]]

অর্থ :- দেবী গন্ধেশ্বরী সিংহারুঢ়া, ললাটে চন্দ্রকলা যুক্তা, মরকত মনির ন্যায় প্রভাময়ী, চারহাতে শঙ্খ, চক্র, ধনুর্বাণধারিণী। তিনি ত্রিনয়ন শোভিতা। কেয়ূর হার, বলয়, শব্দায়মান মেখলা এবং পায়ে ঝংকৃত নূপুর পরিহিতা। রত্নের মতো উজ্জ্বল কুণ্ডল দ্বারা ভূষিতা, সেই দেবী দুর্গা আমাদের সকল দুর্গতি বিনাশ করুন।


উৎপত্তি:- 


গন্ধেশ্বরী শব্দটি এসেছে গন্ধ ও ঈশ্বরী থেকে । 

১)ব্যোম তত্ত্বে হল শুধু শব্দ।

২) মরুৎ তত্ত্বে হল শব্দ+স্পৰ্শ।

৩) তেজঃতত্ত্বে হল শব্দ+ স্পর্শ +রূপ

৪) অপঃতত্ত্বে হল শব্দ+স্পর্শ +রূপ+রস।

৫) ক্ষিতিতত্ত্বে হল শব্দ+স্পর্শ +রূপ+রস+গন্ধ৷

অর্থাৎ গন্ধেশ্বরী হলেন পঞ্চ ভূতের অধীশ্বরী বা ব্রহ্মাণ্ড প্রসবিনী । 


ইতিহাস:- 


গন্ধেশ্বরী হলেন তান্ত্রিক দেবী , বৈদিক মতে পূজিতা হন না । পরবর্তীতে বৌদ্ধ ধর্মেও ইনি পূজিতা হন। 

 হিন্দু- বৌদ্ধ নির্বিশেষে তাঁর পূজা এক কালে বঙ্গীয় বণিক দের নানা শাখায় অনুষ্ঠিত হত বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন। বাংলাদেশের পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে অন্যান্য হিন্দু দেব দেবীর সাথে গন্ধেশ্বরীর -ও একটি মূর্তি আছে। তবে সেটি গন্ধেশ্বরী দেবীর কিনা এ নিয়ে সন্দেহ আছে । কারণ দেবীর উপরের হাত দুটো ভাঙা এবং নীচের দুটিহাতে বর ও অভয়মুদ্রা আছে । ধ্যান মন্ত্র অনুসারে মা মেলে না। হয়তো ওটি ভুবনেশ্বরী জাতীয় কোন দেবীর মুর্তি। 


কাহিনী:- 


মহানন্দীশ্বর উপপুরাণে তাঁর কাহিনী পাওয়া যায়। 

অসুর সুভূতির ঔরসে ও তপতী নামক এক রাক্ষসীর গর্ভে গন্ধাসুর জন্মগ্রহণ করেছিল। নারীলোভী অসুর সুভূতি একবার বৈশ্যকন্যা সুরূপাকে হরণ করতে গিয়ে বৈশ্যগণ কর্তৃক অপমানিত তিরস্কৃত ও হৃতসর্ব্বস্ব হয়। বাবার সেই অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য গন্ধাসুর বৈশ্যবংশ ধ্বংস করিতে উদ্যত হয়েছিল। তার অনুচরগণ একদিন সুবর্ণবট বৈশ্যকে বধ করছিল । এরপর তারা সুবর্ণবটের গর্ভবতী স্ত্রীর দিকে ধাওয়া করে । চন্দ্রাবতী ( সুবর্ণবটের স্ত্রী )  গর্ভস্থ শিশুকে রক্ষা করার জন্য বনে প্রবেশ করেন। এরপর তিনি অরণ্য-মধ্যে একটি কন্যা প্রসব করে মারা যান।


মহর্ষি কশ্যপ ধ্যানযোগে চন্দ্রাবতীর গর্ভে ভূমি দেবীর অংশাবতার জন্মগ্রহণ করেছেন জেনে তাঁকে নিজের আশ্রমে এনে পালন করতে লাগলেন। ঋষি সেই মিষ্ট গন্ধযুক্তা মেয়ের নাম গন্ধবতী রাখিলেন। যৌবনে পা দেবার পর গন্ধবতী কাশ্যপের কাছ থেকে পিতার মৃত্যুর ও অরণ্য মধ্যে মায়ের শোচনীয় মৃত্যুর বিবরণ জানতে পারলেন ।  এরপর তিনি অসুরগণের মৃত্যু কামনায় দুর্গার তপস্যা শুরু করেন। গন্ধাসুর গন্ধবতীর অলৌকিক সৌন্দর্যের কথা জেনে কামাসক্ত হয়ে পড়ে । গন্ধবতীকে হরণ করার জন্য সসৈন্যে তার আশ্রমে আসল। কিন্তু অসুরের কথায়, শব্দে, বিভিন্ন কৌশলে গন্ধবতীর ধ্যানভঙ্গ হল না। তখন ক্রুদ্ধ গন্ধাসুর সবলে গন্ধবতীর চুল টেনে ধরে ধর্ষণ করতে উদ্যত হল। কিন্তু অসুরতেজ পরাভূত হল । গন্ধাসুর গন্ধবতীকে যোগাসন থেতে বিচলিত করতে পারল না । গন্ধবতী বিচলিত হলেন না । কিন্তু যজ্ঞ কুণ্ডের আগুন থেকে মূলদুর্গা আবির্ভূতা হন । 


গন্ধাসুর দেবীকে দেখে দেবীর সঙ্গে যুদ্ধে রত হল। ঘোরতর যুদ্ধের পর দেবী শূলাঘাতে অসুরের প্রাণ বিনাশ করলেন ও তার প্রকাণ্ড শরীর সমুদ্র-মধ্যে নিক্ষেপ করলেন। দেবীর ইচ্ছায় সেই শরীর গন্ধদ্রব্যের আকর-ভূমি গন্ধদ্বীপে রূপান্তরিত হল ৷ তারপর ভগবান ব্রহ্মা, বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতাদের সঙ্গে মিলে দেবীর পূজা করলেন। গন্ধাসুর-নাশিনী মূলদুর্গা গন্ধেশ্বরী নামে পরিচিত হলেন। বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে ভগবতী গন্ধেশ্বরী -মূৰ্ত্তিতে প্রকাশিত হয়ে গন্ধাসুরকে বিনাশ করেছিলেন। 

এই কারণে দেবীর মন্ত্রে গন্ধাসুর-বিনাশিনী নামটা পাওয়া যায়।


গন্ধেশ্বরি জগন্মাতর্-গন্ধাসুরনাশিনি ।

বানিজ্যসম্পদপ্রদে দেবি মহামায়ে নমহস্তুতে।।


ভবপুরাণে দেবী গন্ধেশ্বরী র অন্যরকম কাহিনী পাওয়া যায়। সেটি এইরূপ - 


গন্ধাসুর নারদের মুখে গন্ধেশ্বরী দেবীর সৌন্দর্যের কথা শুনে কামাসক্ত হয়ে পড়ে এবং দেবীকে পত্নীরূপে লাভের আশা কখোনোই পূর্ণ হবে না ভেবে ভগবান শিব এর শরণাপন্ন হয়ে কঠোর তপস্যা করে। ভগবান শিব প্রসন্ন হলে, গন্ধাসুর প্রার্থনা করেছিল তে তার রূপ যেন অবিকল শিবের মতই হয় । ভোলানাথ সেই বরই প্রদান করলেন। অসুর সম্পূর্ণ শিবের মত আকৃতি নিল। কিন্তু প্রকৃতিতে সেই অসুর-প্রবৃত্তিই রয়ে গেল।


তখন অসুর মহাদেবের অনুপস্থিতিতে কৈলাসে গিয়ে দেবীকে প্রার্থনা করল। দেবী অসুরের দুরাশা দেখে মূলদুর্গা রূপ ধারণ করে যুদ্ধে তার প্রাণ বিনাশ করলেন। দেবীর ইচ্ছায় গন্ধাসুরের দেহ গন্ধমাদন পর্বতে রূপান্তরিত হল। গন্ধাসুর এর বিভিন্ন অঙ্গ থেকে বিভিন্ন গন্ধদ্রব্যের উৎপত্তি হয়েছিল। এরপর দেবগণ কর্তৃক দেবী পূজিত হয়ে গন্ধেশ্বরী নামে বিখ্যাত হলেন।


গন্ধেশ্বরী গায়ত্রী মন্ত্র:- 


ওঁ হ্রীং গন্ধেশ্বরীদুর্গায়ৈ বিদ্মহে বাণিজ্যবৃদ্ধিকারণ্যৈ ধীমহি তন্নো দেবী প্রচোদয়াৎ ।।


উপসংহার:- 

গন্ধবণিকরা মনে করেন এই দেবীর পূজা করলে বানিজ্যে সফলতা আসে । তাই তারা দেবীর পদতলে বাটখারা, দাঁড়িপাল্লা প্রভৃতি অর্পন করে পূজা করেন । যদিও দেবীর প্রণাম মন্ত্রে বলা হয়েছে তিনি সকল অভিষ্ট দায়িনী । 

 গন্ধেশ্বরী প্রণাম মন্ত্র :- 

গন্ধেশ্বব়ি নমোহস্তুভ্যং ভক্তাভিষ্ট প্ব়দায়িনি ।

নমোহস্তুভ্যং জগন্মাতুব়্ভোগপোবর্গসাধিকে ।।

তথ্যসূত্র:- 

শ্রীশ্রীচণ্ডী,  মহানন্দীশ্বর পুরাণ, উইকিপিডিয়া, ভব পুরাণ 

Comments

Popular posts from this blog

108 Shaktipeethas

Shaktipeethas in Brihad Nila Tantra

Shaktipeethas in Lalitopakhyanam